বেশ অনেকদিন আগের কথা আমি তখন দিনাজপুরের কসবা এলাকায় থাকতাম ওখানে একটা মিশন আছে । মিশনের দক্ষিন দিকে তাদের নিজস্ব একটা কবরস্থান আছে ।
এর পরই একটা আমবাগান । দিনের বেলাও বেশ একটা অন্ধকার অন্ধকার ভাব থাকতো । পশ্চিম দিকে একটা
ঘাগরা (ক্যানেল) ছিলো, দিনের বেলাতেই ঘাগরার পাশ দিয়ে নাদুস নুদুস শিয়ালের আনাগোনা চোখে পড়তো । এগুলো মানুষ দেখলেও ভয়পেত না, এর অবশ্য কারনও ছিলো, আরেকটু পশ্চি
মে এগোলেই কাঞ্চন নদী । সারা বৎসরই নদীটা মরে থাকতো মানে হাটু ডোবা পানি থাকতো শুধু বর্ষাকালে পূর্নযৌবনা হয়ে আশপাশের এলাকা বানে ভাসাতো । ঐ নদীর পাড়েই ছিলো হিন্দুদের শশ্মানঘাট । বিত্তবানদের শবদেহ বেলকাঠ (কাঁচা কাঠও জ্বলে) ধূপ ও ঘী ঢেলে পোড়ানো হত ।
আগুন দেওয়ার পর শবদেহ মাঝে মাঝে উঠে বসতো, তখন বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে আবার শব দেহটিকে শুইয়ে দেওয়া হত । কার্যকারন জানা থাকলেও একাকী অন্ধকার রাতে
বিষয়টি মনে পড়লে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে । দরিদ্রদের শবদেহ কোনমতে একটু মুখাগ্নী করেই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত । এই লাশগুলি প্রায়ই নদীর পারে আটকে ভেসে থাকতো আর শিয়ালগুলি মহাসমারোহে তাই দিয়ে ভূরিভোজটা সেরে নিতো, ফলে এদের ভাবখানা ছিলো এমন,যারে আমি খাই তারে আমি ডরামু ক্যা? আমবাগানের
পুর্বদিকেও একটা বিরাট গনকবরস্থান আছে, শিয়ালগুলি মাঝেমাঝে এখানকার কবর থেকেও লাশ তুলে ফেলতো । এই কবরস্থানের পাশদিয়ে একটা রাস্তা গেছে দক্ষিন দিকে ঐ রাস্তা থেকেই একটা শাখা রাস্তা গেছে পূর্বদিকে । এই রাস্তা দিয়ে কসবা থেকে পুলহাট যাওয়া যায় এবং ঐ দিক দিয়েই পর্যটন স্থান রামসাগর যাওয়া যায়। এই শাখা
রাস্তার দুপাশে নিবিড় ঘন আমবাগান ছিলো । এই রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলে বামদিকে একটি বিরাট অশ্বথ্থ গাছ এবং পার্শ্বে একটি বকুল ফুলের গাছ ছিলো ।
এই অশ্বথ্থ গাছের নিচেই কয়েকটি কবর সহ সম্ভবত একটি পারিবারিক কবরস্থান ছিলো । এর পরেই ছিলো আমার এক বন্ধুর বাসা। প্রায়ই বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে রাস্তার উপর বিছিয়ে থাকা বকুল ফুল কুড়িয়ে পকেটে রেখে দিতাম এবং সারাক্ষন ফুলের সৌরভ উপভোগ করতাম বকুল ফুল শুকিয়ে গেলেও সৌরভ ছড়ায় ।
ফুল কুড়াবার সময় ছাড়াও ঐ পথে যেতে আসতে প্রায়ই একটা পাগলকে দেখতাম গোরস্থানের ঘাস বাছতে । কবরগুলি ছিলো ফ্ল্যাট কারন কালের প্রবাহে মাটির উচ্চতা সমতল হয়ে গিয়েছিলো । পাগলটা কবরের চারপাশের ঘাস তুলে ফেলে শুধু কবরের উপর আয়তকার করে ঘাস রেখে দিত ফলে কবরগুলির অবস্থান বুঝা যেতো এবং কবরস্থানটিকে অনেকগুলি আয়তক্ষেত্রের সমাহার বলে মনে হত। শুনেছিলাম পাগলটির স্ত্রীর কবরও ঐখানে ছিলো ।
স্ত্রীকে ভীষন ভালবাসতো তাই স্ত্রীর মৃত্যুর পরও তার কবরের পাশেই সারাক্ষন বসে থাকতো । ভোরবেলা ঐ পথে গেলে পাগলটিকে হয় ঘাস বাছতে না হয় ছোট একটা শলার ঝাড়ু দিয়ে কবরস্থানটিকে ঝাড়ু দিতে দেখতাম আর নাহয় দেখতাম একটা কাঠিদিয়ে মাটিতে আকিবুকি কাটছে (কি জানি হয়তো বা প্রান প্রিয় স্ত্রীকে মনের সব মাধুরী মিশিয়ে পত্র লিখতো) আর কিছু করার না থাকলে ঐ অশ্বথ্থ গাছের নিচেই ঝিম মেরে বসে থাকতো, কিন্তু রাতের বেলা পাগলটিকেকবরস্থানের আশেপাশে কখনো দেখিনি, কোথায় যেতো কোথায় থাকতো জানতামনা।
একদিন বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিতে দিতে বেশ রাত হয়ে গেলো । এদিকে বন্ধুর মা মানে খালাম্মা খালি মুখে আসতে দিতে চাইলেন না রাতের খাবার খেয়ে আসতেই হবে ।
কি আর করা স্নেহের দাবীর কাছে পরাভুত হয়ে খাওয়ার জন্য রয়ে গেলাম । সেদিন ছিলো চাদনী রাত চৈত্র মাসের শেষদিকের পূর্ণিমা রাত আকাশে ভরা জোৎস্নার বান, আমগাছের শাখা প্রশাখায় পাতায় হালকা বাতাসের দোলায় চাদের আলোর ঝিকিমিকি।
কিন্তু গাছের নীচের ছায়ায় গভীর অন্ধকার । গল্পে গল্পে সময় বয়ে যাচ্ছে একসময় রান্না শেষ করে খালাম্মা খেতে ডাকলেন, খুবই মজা করে মুরগীর মাংশ আর
কাঁচা আমের টুকরা দেওয়া টক মুসুরি ডাল দিয়ে পেট ভরে খেয়ে উঠলাম । এরপর যাওয়ার পালা বন্ধু গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো তারপর সাইকেলে চেপে রওনা দিলাম
রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা । মৃদু হাওয়া বইছে, বয়ে আনছে হাস্নাহেনার সৌরভ । একটু সামনেই ছোট্ট ফুলের বাগান সেখানে ফুটে আছে বেলী, দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধা আর গন্ধ বিহীন নয়নতারা বাতাসে ভেসে আসছে বসন্তের আরো নাম না জানা
ফুলের মিশ্র সৌরভ । আম বাগানের নীচে গা ছমছম করা গাঢ় অন্ধকার । চারিদিকে নীরব নিথর শুনশান পরিবেশ শুধু মাঝে মাঝে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় পাতার
মর্মর শব্দে মনে হয় যেন গাছগুলি জীবন্ত হয়ে বাক্যালাপ করছে অথবা এই আদম সন্তানের সাইকেলের শব্দে আলাপে বিঘ্ন ঘটায় মাথা ঝাকিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে ।
সোজা চলে আসবো তা না কবরস্থানটার কাছে এসে আপনা আপনি চোখ চলে গেল অশ্বথ্থ গাছটার গোড়ার দিকে দেখলাম সাদা কাপড় কালো পাড়ের শাড়ী পরা
ঘোমটা দেওয়া এক ফর্সা সুন্দরী মহিলা বসে আছেন । আমি চমকে উঠে থমকে দাড়ালাম নিজের অজান্তেই, নাহলে আমার আরও জোরে সাইকেল দাবড়ে চলে আসার কথা ।আমি আমার মধ্যে থেকে হারিয়ে গেলাম সমস্ত শরীর প্রচণ্ড গরমে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো, গায়ের চামড়া মনে হচ্ছিলো যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছে । মনে হলো বাতাস
বন্ধ হয়ে গেছে, দম আটকে যাচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। এত রাতে এই কবরস্থানের অশ্বথ্থ গাছের গোড়ায় এমন মহিলা এলো কোথা থেকে আমিই বা চলে না
গিয়ে দাড়িয়ে আছি কেন? শত চেষ্টাতেও সাইকেলে প্যাডেল মারতে পারছিনা কেন, কে এত শক্ত করে সাইকেল আটকে রেখেছে ? আবার তাকালাম দেখলাম বাতাসে
ঘোমটাটা ফুলে ফুলে উঠছে। আতঙ্কে আমার দম বেড়িয়ে যাওয়ার মত অবস্থা । আবার তাকালাম মনে হলো পাগলটার বৌ (কেন পাগলটারই বৌ মনে হলো জানিনা হয়তো মনে হওয়ার জন্য আমার উপর কেউ প্রভাব বিস্তার করেছিলো) দিনের বেলা আলো আর লোক চলাচলের কারনে স্বামীর সাথে দেখা করতে না পেরে হয়তো রাতের নির্জনতায় এসেছে স্বামীর সাথে দেখা করতে ।
আবার যখন তাকালাম মনে হলো মহিলাটা কেঁপে কেঁপে ডানে কাত হচ্ছে বামে কাত হচ্ছে । এক সময় কাপতে কাপতে মাটিতে উবুর হয়ে পড়লো সেজদা দেওয়ার ভঙ্গীতে, তারপর আবার উঠলো এবং চিৎ হয়ে পড়ে গেল।লাঠি দিয়ে জাজিমের উপর আঘাত করলে জাজিম যেভাবে কেঁপেকেঁপে উঠে মহিলার কাঁপন ছিলো ঐ রকম, মনে হচ্ছিলো কেউ লাঠি বা বাশ দিয়ে মহিলাটিকে ভয়ানক ভাবে আঘাত করছে। মনে হলো শশ্মানে
উঠেবসা লাশকে যেন বাশ দিয়ে পিটিয়ে শোয়ানো হলো ।ঘুমের মধ্যে মানুষকে বোবায় ধরলে মানুষ যেমন অসহায় হয়ে পড়ে হাত পা নাড়ানো যায় না আমার অবস্থা যেন হয়েছে তেমন নড়তে চড়তে পারছিনা অথচ চলচ্চিত্রের মত সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া
ঘটনাবলী দেখছি । আসলে মহিলাটাকে কি জীবদ্দশায় পিটিয়ে মারা হয়েছে ? আমাকে কি সেই ঘটনার স্বাক্ষী করার চেষ্টা করছেন? পাগলটা কি অনুতাপের যন্ত্রনা
আর পাপের বোঝা সইতে না পেরে পাগল হয়ে গেছে? তাই অবচেতন মনের নির্দেশে বার বার স্ত্রীর কবরের কাছে ফিরে আসে? অকস্মাৎ এক অপার্থীব চিৎকারে
সম্বিত ফিরে পেলাম (সম্ভবত কোন পেচার কর্কশ ডাক)দেখলাম কোথাও কেউ নেই আকাশে বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ কাছের দেবদারু গাছের পাকা ফল খাওয়ার প্রতিযোগীতায় হুটোপটি আর ক্যাচ ক্যাচ শব্দ । চারিদিকের অন্ধকারে জোনাকি পোকার আলোর ঝিকিমিকি। গোটা দুয়েক ছুচোর একটা মরা ব্যাঙের ভাগ নিয়ে লড়াই আর ঝগড়াঝাটি সব কিছুই স্বাভাবিক । তাহলে আমি এখানে দাড়িয়ে কেন ? প্রকৃতির স্বাভাবিক দৃশ্য আমার অবশ ভাবটি ধীরে ধীরে কাটিয়ে দিলো। বুকে কাপুনি নিয়ে আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরলাম ঘড়িতে রাত তখন পৌনে একটা অথচ বন্ধুর বাসা সাইকেলে দশ মিনিটের পথ তাহলে এতক্ষন ধরে আমি কি করলাম, কোথায় ছিলাম, নাকি অন্য কোন জগতের ঘটে যাওয়া কোন দৃশ্যের রিপ্লে দেখছিলাম । কিছুই ভেবে পাচ্ছিলামনা, এটা কি হলো,কেন হলো, আতঙ্কে আমি মারাও যেতে পারতাম ।
আসলে পূর্বের ঘটে যাওয়া কোন অন্যায়ের স্বাক্ষী করার জন্যই কি এটা প্রকৃতির কোন খেলা ছিলো?
আজও এর উত্তর খুজে ফিরি ।
(সংগৃহীত)