আজ বাড়ি ফিরতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। অফিসের কাজে গাজীপুর গিয়েছিল
রেজওয়ান। রাস্তায় তীব্র যানজট। সেই সঙ্গে ঝিরঝির বৃষ্টি। গাড়ির ভিতরে
বসে বিরক্তিকর ভ্যাপসা সময় কাটছিল । আটটার দিকে নাজিয়াকে অবশ্য ফোন
করেছিল । নইলে নাজিয়া টেনশন করত। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে
রেজওয়ানও অবশ্য চাপা উদ্বেগ বোধ করছিল। প্রায় এগারোটার মতো বাজে,
সুমাইয়া যদি ঘুমিয়ে পড়ে। মেয়েটার সঙ্গে কথা না -বললে সারাদিনের
ক্লান্তি কাটে না, স্বস্তি পায় না, সারাদিনের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কাটে না ।
মেয়েটা এবার তিন বছরে পা দিল। টকটক করে কথা বলে। কাল অবশ্য শুক্রবার।
সারাদিন ঘরে থাকবে রেজওয়ান । সুমাইয়াকে আদর করবে।
সুমাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। বিষন্ন বোধ করে রেজওয়ান। বাসি কাপড়ে কিছুতেই ঘুমিয়ে-থাকা মেয়েকে ছুঁতে দেবে না নাজিয়া। কাজেই, একেবারে গোছল সেরে, ঘুমন্ত মেয়েকে আদর করে খেতে বসল রেজওয়ান ।
বাইরে তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল। নাজিয়াও বসল খেতে। রেজওয়ান কতবার বলেছে- আমার দেরি হলে তুমি খেয়ে নিও। আমার জন্য অপেক্ষা করো না। নাজিয়া কথা শোনে না। বরং রেজওয়ান- এর জন্য এটা-ওটা কত কী যে রান্না করে রাখে। নাজিয়া আজ চিংড়ি মাছের কচুরি রান্না করেছে । সাধারণত বাংলাদেশে এ পদটা কেউ রাঁধে না। নাজিয়া টিভি দেখে শিখেছে। (নাজিয়া খুব জি-বাংলা দেখে ...) অন্য কোথাও চিংড়ি মাছের কচুরি খেলে কেমন লাগত কে জানে, তবে নাজিয়া রেঁধেছে বলে খেতে ভালো লাগে রেজওয়ান- এর। যদিও তীব্র ভাবে সুমাইয়াকে মিস করছে। সুমাইয়া খাওয়ার টেবিলে থাকলে এতক্ষণে কত কথা বলে ফেলত। ও ভাবে খেও না বাবা, এভাবে খাও, আমার মতো করে ...
খাওয়ার পর হাতমুখ ধুয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরালো রেজওয়ান । টিভিতে টক শো হচ্ছে। অনেক রাত অবধি টিভি দেখে রেজওয়ান। অফিসের নানা উদ্বেগে আজকাল ঘুম কমে এসেছে। আর একটা ফ্ল্যাট কেনার দুশ্চিন্তাও আছে । কিছু টাকা জমেছে হাতে। নাজিয়া অবশ্য গাড়ি কিনতে বলে । ওর বড় বোন মেঘনা আপা গত মার্চে গাড়ি কিনেছে। রেজওয়ান এখুনি গাড়ি কিনতে চায় না। সুমাইয়ার জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনতে চায়। নাজিয়া বলে, ফ্ল্যাট পরে হবে আগে গাড়ি কেনো। এ নিয়ে দু-জনের মধ্যে সামান্য মনোমালিন্য চলছে। এসব ছোটখাটো খিটিমিটি ছাড়া ওভালঅল হ্যাপি রেজওয়ান। সবচে বড় কথা নাজিয়া সিগারেট অ্যালাও করে।
একটু পর দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে নাজিয়া এসে ড্রইংরুমে ঢুকল। বলল, এই শোনো। বলতে ভুলে গেছি। আজ না তোমার একজন ফ্রেন্ড এসেছিল।
কখন?
সন্ধ্যার পর ।
কে? কি নাম? রেজওয়ান অবাক। কে এল আবার? বাসায় আমাকে না-পেলে তো ফোন করত। করেনি।
নাম বলল মিটুল। ডাক নাম বলাতে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। নাজিয়া বলল। বলে পাশে বসল ।
রেজওয়ান ভীষণ চমকে ওঠে। হাত থেকে সিগারেট পড়ে যায় মেঝের ওপর। পাখার বাতাসে গড়িয়ে যায় কিছুটা।
কি হল?
না, কিছু না। বলতে-বলতে ঝুঁকে সিগারেট তুলে নেয় রেজওয়ান। মুখচোখ স্বাভাবিক রাখার প্রাণপন চেষ্টা করছে। মিটুল এসেছিল? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ও তো ...
নাজিয়া বলে, উনি বললেন উনি তোমার কলেজ ফ্রেন্ড। বগুরায় থাকার সময় নাকি একসঙ্গে পড়তে। অনেক দিন নাকি তোমাদের দেখা হয় না। ঢাকায় কি একটা কাজে এসেছেন। তাই দেখা করতে এসেছেন। টিভিতে বিজ্ঞাপন হচ্ছে। নাজিয়া রিমোটটা তুলে নিয়ে ভলিউম কমিয়ে দেয়।
হু। ঠিকানা কোথায় পেল? জিগ্যেস করনি?
না। মনে ছিল না। আমি ভেবেছিলাম ঠিকানা তুমি দিয়েছ। নইলে ঠিকানা পাবেন কি ভাবে? আমরা মাত্র গতমাসে এ বাড়িতে এলাম। চা-মিষ্টি দিলাম। কিছুই খেলেন না। সুমাইয়া কোলে নিতে কতবা ডাকলেন। তো তোমার মেয়ে কিছুতেই ওনার কাছে যাবে না। শেষে কান্নাকাটি করল। আমি ও ঘরে ঢেকে সুমাইয়া বললাম, আঙ্কেলের কাছে যাচ্ছো না কেন? সুমাইয়া বলল, আমার ভয় করে। রান্নাঘরে চা বানানোর সময় রোজিও বলল, লোকটা কে মামী, দেইখা আমার কেমন ডর করতাছে। আমি বললাম, উনি তোর মামার বন্ধু। ভয়ের কি আছে।
তুমি ভয় পাও নি?
আমি? আমি কেন ভয় পাব? উনি জ্বিন না ভূত? তবে আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল। তোমার বন্ধুর চোখ দুটি কি শীতল। তো অনেকেরই তো অমন শীতল চোখ হয়। মেঘনা আপার শাশুড়ির চোখও তো শীতল।
আমায় ফোন করনি কেন? রেজওয়ানের কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনায়।
কে বলল করিনি? ফোঁস করে ওঠে নাজিয়া। রিং টোনের বদলে ঝিরঝির শব্দ পেলাম।
কখন? রেজওয়ানের বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে।
সাড়ে সাতটার দিকে।
হঠাৎ রেজওয়ান-এর কেমন শীত করতে থাকে। এসব কি বলছে নাজিয়া? সাড়ে সাতটার সময় গাড়িতে বসে ছিল রেজওয়ান । তখন একবার রিং বেজেছিল মনে পড়ছে। মোবাইলটা তুলে কানে ঠেকাতেই ঝিরঝির শব্দ পেয়েছিল। যান্ত্রিক ক্রুটি মনে করে অফ করে দিয়েছিল মোবাইল। আশ্চর্য! মিটুল এসেছিল? কিন্তু কি ভাবে তা সম্ভব। মিটুল তো এক শনিবারের ভোরে ... মিটুলের ঘটনাটা কখনও নাজিয়াকে বলা হয়নি ।
উনি অবশ্য বেশিক্ষণ বসলেন না। চলে যাওয়ার আগে ওনার মোবাইল নম্বর চাইলাম । উনি বললেন যে, আমার মোবাইল নেই। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, ওমাঃ নেই কেন? বাংলাদেশে সবার মোবাইল আছে। উনি বললেন, আমি যেখানে থাকি সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। জিগ্যেস করলাম, আশ্চর্য!আপনি কোথায় থাকেন বলেন তো? খাগড়াছড়ি? শুনেছি ওসব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে না। উনি কিছু বললেন না। বরং হেসে এড়িয়ে গেলেন।
এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বোধ করছিল রেজওয়ান। সেই সঙ্গে গভীর এক কৌতূহল গ্রাস করতে থাকে রেজওয়ান কে । সে জিগ্যেস করে, কি পরে ছিল মিটুল?
লম্বা ঢোলা আলখাল্লার মতো কালো পাঞ্জাবি। মাথায় লাল তুর্কি টুপি। ফরসা মুখে চাপ দাড়ি। অদ্ভূত একটা আতর-আতর গন্ধ পাচ্ছিলাম। তোমার ফ্রেন্ড বুঝি খুব রিলিজিয়াস? না?
রেজওয়ান চুপ করে থাকে। ও কি বলবে? কলেজ জীবনে মিটুল যে খুব রিলিজিয়াস ছিল তা কিন্তু নয়। অন্যদের মতোই ছিল ও। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না-পরলেও জুম্মার দিন ঠিকই গোছল করে পাঞ্জাবিতে আতর মেখে মসজিদে যেত। দু-জনে একবার বগুড়া থেকে ঢাকা এসেছিল। দিনটা ছিল শুক্রবার। দুপুরটা কেটেছিল চিড়িয়াখানায় । জীবনে প্রথম চিড়িয়াখানার বিচিত্র জীবজন্তু দেখে মিটুল এতই উত্তেজিত ছিল যে জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের খোঁজ করার কথা ভাবেনি ও ।
পাশের ঘরে সুমাইয়া কেঁদে উঠল। নাজিয়া উঠে দ্রুত পায়ে চলে যায়।
টিভিতে আবার টক শোয়ে বক্তারা কথা বলতে শুরু করেছে। অন্য দিন হলে মন দিয়ে শুনত। আজ মন বসছে না। বসবে না। মিটুলের কথাই বারবার মনে পড়ছে। পড়বে। মিটুলের কথা মাঝে-মাঝে অবশ্য মনে পড়ে । সুমাইয়াকে আদর করার সময় প্রায়ই মনে হয়- মিটুল এ জীবন পেল না। আশ্চর্য! আজ মিটুল এসেছিল। তা কি করে সম্ভব? মিটুল তো শনিবারের ভোরে ... রেজওয়ান সিগারেট টানে। একটার পর একটা। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যায়।
নাজিয়া ও ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রেজওয়ান অনেক রাতে ড্রইংরুমের আলো আর টিভি অফ করে বারান্দায় এসে বসে।
তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টিটা পড়েই যাচ্ছিল। বারান্দায় ঘোর অন্ধকার। গ্রিলের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে রেজওয়ান। নীচে ঝিরঝির বৃষ্টির ভিতর একটা ঘুমন্ত শহর। সেই শহরটির ঘুমন্ত বাড়িঘর। সেই ঘুমন্ত ঘরবাড়ির মধ্যে মানুষ। কেউ জেগে, কেউ-বা ঘুমিয়ে। সেই সব মানুষদের বিচিত্র সব ইতিহাস। বিস্ময়কর অতীত।
মাঝরাতের এই অন্ধকার ভিজে মুহূর্তে অনিবার্যভাবে আরও এক অতীত ফিরে আসে ...
রেজওয়ানের বাবার পোস্টিং তখন বগুড়ায় । সদ্য কলেজে উঠেছে রেজওয়ান। মিটুলের সঙ্গে কলেজে পরিচয়। লম্বা, ফরসা হাসিখুশি প্রাণবন্ত একটা ছেলে। সারাক্ষণ কিছু –না- কিছু আইডিয়া মাথায় ঘুরছে। কলেজে পড়ছে, কিন্তু দুজনের কেউই তখন পর্যন্ত ঢাকা শহর দেখেনি। মিটুল বলল, চল ঢাকা শহরে যাই। আজ রাতে রওনা হয়ে কাল দিনটা থেকে কালই আবার রওনা হব। রেজওয়ানের শরীরে উঠতি বয়েসের রক্ত ছনমন করছে । সেও রাজি। ঝোঁকের মাথায় বৃহস্পতিবার রাতে বাসে ওঠে বসে। ঢাকায় মিটুলের এক ফুপু ছিল। কলাবাগানে। সেই ফুপুর বাড়িতে না-উঠে সারাদিন টইটই করে শহরটা ঘুরে বেড়াল। দিনটা ছিল শুক্রবার। চিড়িয়াখানায় জিরাফ দেখে মিটুলের সে কি উচ্ছ্বাস। আফ্রিকায় জিরাফ শিকার করতে যাবে-এমন পরিকল্পনার কথাও বলে ফেলল ও। চিড়িয়াখানা থেকে তারপর সোজা ঢাকা ইউনিভারসিটি। তখন ছায়াময় মেঘলা বিকেলে। মিটুল বলল, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। দেখিস। না, মিটুলের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। বগুড়া ফেরার জন্য রাতে আবার বাসে উঠল ওরা। শনিবারের ভোর। বগুড়া শহর আর ২/৩ কিলো দূরে । ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। রেজওয়ান বসেছিল জানালার ধারে । হঠাৎ মিটুল বলল, সর। আমি জানালার ধারে বসব । রেজওয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মিটুলের সিটে এসে বসে । মিটুল জানালার ধারে সিটে বসার কিছুক্ষণ পরই প্রচন্ড শব্দে বাসটা দুলে উঠে কাৎ হয়ে যায়। রেজওয়ান ডান পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করে ... আর দু-চোখে অন্ধকার টের পায়। ... তারপর রেজওয়ানের জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। মিটুলের আর জ্ঞান ফেরেনি। ওর লাশটা নাকি চেনা যায়নি, ট্রাকের ধাক্কায় এমনই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।
রেজওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সিগারেটে টান দেয়। গ্রিলের ফাঁকে ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভেজা ঘুমন্ত শহরের দিকে তাকায়। কিছু কিছু বাড়ির জানালায় আলো। কিছু কিছু মানুষ এত রাতেও জেগে আছে। কিসের তাড়নায় তারা জেগে আছে? যেমন মিটুল এই মুহূর্তে আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। প্রায়ই মিটুল আমাকে জাগিয়ে রাখে। ভাবায়। সুমাইয়াকে আদর করার সময় আমি ভাবি - মিটুল এ জীবন পেল না। সুমাইয়ার পাতলা চুলের গন্ধ নেওয়ার সময় আমি ভাবি- মিটুল এ জীবন পেল না। নাজিয়াকে আদর করার সময় আমার মনে হয় মিটুল এ জীবন পেল না। কেন পেল না? অ্যাক্সিডেন্টের আগে মিটুল কেন সিট বদলেছিল ? মিটুল সিট না-বদলালে তো মারা যেতাম আমি ।
এই প্রশ্নটা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে।
রেজওয়ান বৃষ্টি ভেজা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হয় মানবজীবনের কি নিয়তি নিদিষ্ট? এমন মনে হয় তার। সে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমি কেন বেঁচে আছি? মিটুল এর বদলে আমি কেন বেঁচে আছি? মিটুল কেন বেঁচে নেই। ওর কেন শনিবার ভোরে বাসের জানালার পাশের সিটে বসতে ইচ্ছে হল? কেন হল?
রেজওয়ান বিয়ের পর নাজিয়াকে কত কথা বলেছে। মিটুলের কথা নাজিয়াকে কখনও বলা হয়নি। ওই অ্যাক্সিডেন্টের পর পরই রেজওয়ানের বাবা খুলনায় বদলী হয়ে গেলেন। মিটুলের স্মৃতি রয়ে গেল মনের কোণে ... কেবল শনিবার ভোর এলে এক ধরনের অস্বস্তি হত ...
সেই মিটুল আজ এসেছিল।
কেন এসেছিল?
সুমাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। বিষন্ন বোধ করে রেজওয়ান। বাসি কাপড়ে কিছুতেই ঘুমিয়ে-থাকা মেয়েকে ছুঁতে দেবে না নাজিয়া। কাজেই, একেবারে গোছল সেরে, ঘুমন্ত মেয়েকে আদর করে খেতে বসল রেজওয়ান ।
বাইরে তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল। নাজিয়াও বসল খেতে। রেজওয়ান কতবার বলেছে- আমার দেরি হলে তুমি খেয়ে নিও। আমার জন্য অপেক্ষা করো না। নাজিয়া কথা শোনে না। বরং রেজওয়ান- এর জন্য এটা-ওটা কত কী যে রান্না করে রাখে। নাজিয়া আজ চিংড়ি মাছের কচুরি রান্না করেছে । সাধারণত বাংলাদেশে এ পদটা কেউ রাঁধে না। নাজিয়া টিভি দেখে শিখেছে। (নাজিয়া খুব জি-বাংলা দেখে ...) অন্য কোথাও চিংড়ি মাছের কচুরি খেলে কেমন লাগত কে জানে, তবে নাজিয়া রেঁধেছে বলে খেতে ভালো লাগে রেজওয়ান- এর। যদিও তীব্র ভাবে সুমাইয়াকে মিস করছে। সুমাইয়া খাওয়ার টেবিলে থাকলে এতক্ষণে কত কথা বলে ফেলত। ও ভাবে খেও না বাবা, এভাবে খাও, আমার মতো করে ...
খাওয়ার পর হাতমুখ ধুয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরালো রেজওয়ান । টিভিতে টক শো হচ্ছে। অনেক রাত অবধি টিভি দেখে রেজওয়ান। অফিসের নানা উদ্বেগে আজকাল ঘুম কমে এসেছে। আর একটা ফ্ল্যাট কেনার দুশ্চিন্তাও আছে । কিছু টাকা জমেছে হাতে। নাজিয়া অবশ্য গাড়ি কিনতে বলে । ওর বড় বোন মেঘনা আপা গত মার্চে গাড়ি কিনেছে। রেজওয়ান এখুনি গাড়ি কিনতে চায় না। সুমাইয়ার জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনতে চায়। নাজিয়া বলে, ফ্ল্যাট পরে হবে আগে গাড়ি কেনো। এ নিয়ে দু-জনের মধ্যে সামান্য মনোমালিন্য চলছে। এসব ছোটখাটো খিটিমিটি ছাড়া ওভালঅল হ্যাপি রেজওয়ান। সবচে বড় কথা নাজিয়া সিগারেট অ্যালাও করে।
একটু পর দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে নাজিয়া এসে ড্রইংরুমে ঢুকল। বলল, এই শোনো। বলতে ভুলে গেছি। আজ না তোমার একজন ফ্রেন্ড এসেছিল।
কখন?
সন্ধ্যার পর ।
কে? কি নাম? রেজওয়ান অবাক। কে এল আবার? বাসায় আমাকে না-পেলে তো ফোন করত। করেনি।
নাম বলল মিটুল। ডাক নাম বলাতে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। নাজিয়া বলল। বলে পাশে বসল ।
রেজওয়ান ভীষণ চমকে ওঠে। হাত থেকে সিগারেট পড়ে যায় মেঝের ওপর। পাখার বাতাসে গড়িয়ে যায় কিছুটা।
কি হল?
না, কিছু না। বলতে-বলতে ঝুঁকে সিগারেট তুলে নেয় রেজওয়ান। মুখচোখ স্বাভাবিক রাখার প্রাণপন চেষ্টা করছে। মিটুল এসেছিল? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ও তো ...
নাজিয়া বলে, উনি বললেন উনি তোমার কলেজ ফ্রেন্ড। বগুরায় থাকার সময় নাকি একসঙ্গে পড়তে। অনেক দিন নাকি তোমাদের দেখা হয় না। ঢাকায় কি একটা কাজে এসেছেন। তাই দেখা করতে এসেছেন। টিভিতে বিজ্ঞাপন হচ্ছে। নাজিয়া রিমোটটা তুলে নিয়ে ভলিউম কমিয়ে দেয়।
হু। ঠিকানা কোথায় পেল? জিগ্যেস করনি?
না। মনে ছিল না। আমি ভেবেছিলাম ঠিকানা তুমি দিয়েছ। নইলে ঠিকানা পাবেন কি ভাবে? আমরা মাত্র গতমাসে এ বাড়িতে এলাম। চা-মিষ্টি দিলাম। কিছুই খেলেন না। সুমাইয়া কোলে নিতে কতবা ডাকলেন। তো তোমার মেয়ে কিছুতেই ওনার কাছে যাবে না। শেষে কান্নাকাটি করল। আমি ও ঘরে ঢেকে সুমাইয়া বললাম, আঙ্কেলের কাছে যাচ্ছো না কেন? সুমাইয়া বলল, আমার ভয় করে। রান্নাঘরে চা বানানোর সময় রোজিও বলল, লোকটা কে মামী, দেইখা আমার কেমন ডর করতাছে। আমি বললাম, উনি তোর মামার বন্ধু। ভয়ের কি আছে।
তুমি ভয় পাও নি?
আমি? আমি কেন ভয় পাব? উনি জ্বিন না ভূত? তবে আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল। তোমার বন্ধুর চোখ দুটি কি শীতল। তো অনেকেরই তো অমন শীতল চোখ হয়। মেঘনা আপার শাশুড়ির চোখও তো শীতল।
আমায় ফোন করনি কেন? রেজওয়ানের কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনায়।
কে বলল করিনি? ফোঁস করে ওঠে নাজিয়া। রিং টোনের বদলে ঝিরঝির শব্দ পেলাম।
কখন? রেজওয়ানের বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে।
সাড়ে সাতটার দিকে।
হঠাৎ রেজওয়ান-এর কেমন শীত করতে থাকে। এসব কি বলছে নাজিয়া? সাড়ে সাতটার সময় গাড়িতে বসে ছিল রেজওয়ান । তখন একবার রিং বেজেছিল মনে পড়ছে। মোবাইলটা তুলে কানে ঠেকাতেই ঝিরঝির শব্দ পেয়েছিল। যান্ত্রিক ক্রুটি মনে করে অফ করে দিয়েছিল মোবাইল। আশ্চর্য! মিটুল এসেছিল? কিন্তু কি ভাবে তা সম্ভব। মিটুল তো এক শনিবারের ভোরে ... মিটুলের ঘটনাটা কখনও নাজিয়াকে বলা হয়নি ।
উনি অবশ্য বেশিক্ষণ বসলেন না। চলে যাওয়ার আগে ওনার মোবাইল নম্বর চাইলাম । উনি বললেন যে, আমার মোবাইল নেই। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, ওমাঃ নেই কেন? বাংলাদেশে সবার মোবাইল আছে। উনি বললেন, আমি যেখানে থাকি সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। জিগ্যেস করলাম, আশ্চর্য!আপনি কোথায় থাকেন বলেন তো? খাগড়াছড়ি? শুনেছি ওসব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে না। উনি কিছু বললেন না। বরং হেসে এড়িয়ে গেলেন।
এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বোধ করছিল রেজওয়ান। সেই সঙ্গে গভীর এক কৌতূহল গ্রাস করতে থাকে রেজওয়ান কে । সে জিগ্যেস করে, কি পরে ছিল মিটুল?
লম্বা ঢোলা আলখাল্লার মতো কালো পাঞ্জাবি। মাথায় লাল তুর্কি টুপি। ফরসা মুখে চাপ দাড়ি। অদ্ভূত একটা আতর-আতর গন্ধ পাচ্ছিলাম। তোমার ফ্রেন্ড বুঝি খুব রিলিজিয়াস? না?
রেজওয়ান চুপ করে থাকে। ও কি বলবে? কলেজ জীবনে মিটুল যে খুব রিলিজিয়াস ছিল তা কিন্তু নয়। অন্যদের মতোই ছিল ও। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না-পরলেও জুম্মার দিন ঠিকই গোছল করে পাঞ্জাবিতে আতর মেখে মসজিদে যেত। দু-জনে একবার বগুড়া থেকে ঢাকা এসেছিল। দিনটা ছিল শুক্রবার। দুপুরটা কেটেছিল চিড়িয়াখানায় । জীবনে প্রথম চিড়িয়াখানার বিচিত্র জীবজন্তু দেখে মিটুল এতই উত্তেজিত ছিল যে জুম্মার নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের খোঁজ করার কথা ভাবেনি ও ।
পাশের ঘরে সুমাইয়া কেঁদে উঠল। নাজিয়া উঠে দ্রুত পায়ে চলে যায়।
টিভিতে আবার টক শোয়ে বক্তারা কথা বলতে শুরু করেছে। অন্য দিন হলে মন দিয়ে শুনত। আজ মন বসছে না। বসবে না। মিটুলের কথাই বারবার মনে পড়ছে। পড়বে। মিটুলের কথা মাঝে-মাঝে অবশ্য মনে পড়ে । সুমাইয়াকে আদর করার সময় প্রায়ই মনে হয়- মিটুল এ জীবন পেল না। আশ্চর্য! আজ মিটুল এসেছিল। তা কি করে সম্ভব? মিটুল তো শনিবারের ভোরে ... রেজওয়ান সিগারেট টানে। একটার পর একটা। অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যায়।
নাজিয়া ও ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রেজওয়ান অনেক রাতে ড্রইংরুমের আলো আর টিভি অফ করে বারান্দায় এসে বসে।
তখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টিটা পড়েই যাচ্ছিল। বারান্দায় ঘোর অন্ধকার। গ্রিলের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে রেজওয়ান। নীচে ঝিরঝির বৃষ্টির ভিতর একটা ঘুমন্ত শহর। সেই শহরটির ঘুমন্ত বাড়িঘর। সেই ঘুমন্ত ঘরবাড়ির মধ্যে মানুষ। কেউ জেগে, কেউ-বা ঘুমিয়ে। সেই সব মানুষদের বিচিত্র সব ইতিহাস। বিস্ময়কর অতীত।
মাঝরাতের এই অন্ধকার ভিজে মুহূর্তে অনিবার্যভাবে আরও এক অতীত ফিরে আসে ...
রেজওয়ানের বাবার পোস্টিং তখন বগুড়ায় । সদ্য কলেজে উঠেছে রেজওয়ান। মিটুলের সঙ্গে কলেজে পরিচয়। লম্বা, ফরসা হাসিখুশি প্রাণবন্ত একটা ছেলে। সারাক্ষণ কিছু –না- কিছু আইডিয়া মাথায় ঘুরছে। কলেজে পড়ছে, কিন্তু দুজনের কেউই তখন পর্যন্ত ঢাকা শহর দেখেনি। মিটুল বলল, চল ঢাকা শহরে যাই। আজ রাতে রওনা হয়ে কাল দিনটা থেকে কালই আবার রওনা হব। রেজওয়ানের শরীরে উঠতি বয়েসের রক্ত ছনমন করছে । সেও রাজি। ঝোঁকের মাথায় বৃহস্পতিবার রাতে বাসে ওঠে বসে। ঢাকায় মিটুলের এক ফুপু ছিল। কলাবাগানে। সেই ফুপুর বাড়িতে না-উঠে সারাদিন টইটই করে শহরটা ঘুরে বেড়াল। দিনটা ছিল শুক্রবার। চিড়িয়াখানায় জিরাফ দেখে মিটুলের সে কি উচ্ছ্বাস। আফ্রিকায় জিরাফ শিকার করতে যাবে-এমন পরিকল্পনার কথাও বলে ফেলল ও। চিড়িয়াখানা থেকে তারপর সোজা ঢাকা ইউনিভারসিটি। তখন ছায়াময় মেঘলা বিকেলে। মিটুল বলল, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। দেখিস। না, মিটুলের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। বগুড়া ফেরার জন্য রাতে আবার বাসে উঠল ওরা। শনিবারের ভোর। বগুড়া শহর আর ২/৩ কিলো দূরে । ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। রেজওয়ান বসেছিল জানালার ধারে । হঠাৎ মিটুল বলল, সর। আমি জানালার ধারে বসব । রেজওয়ান উঠে দাঁড়িয়ে মিটুলের সিটে এসে বসে । মিটুল জানালার ধারে সিটে বসার কিছুক্ষণ পরই প্রচন্ড শব্দে বাসটা দুলে উঠে কাৎ হয়ে যায়। রেজওয়ান ডান পাশে তীব্র ব্যথা অনুভব করে ... আর দু-চোখে অন্ধকার টের পায়। ... তারপর রেজওয়ানের জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। মিটুলের আর জ্ঞান ফেরেনি। ওর লাশটা নাকি চেনা যায়নি, ট্রাকের ধাক্কায় এমনই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।
রেজওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সিগারেটে টান দেয়। গ্রিলের ফাঁকে ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভেজা ঘুমন্ত শহরের দিকে তাকায়। কিছু কিছু বাড়ির জানালায় আলো। কিছু কিছু মানুষ এত রাতেও জেগে আছে। কিসের তাড়নায় তারা জেগে আছে? যেমন মিটুল এই মুহূর্তে আমাকে জাগিয়ে রেখেছে। প্রায়ই মিটুল আমাকে জাগিয়ে রাখে। ভাবায়। সুমাইয়াকে আদর করার সময় আমি ভাবি - মিটুল এ জীবন পেল না। সুমাইয়ার পাতলা চুলের গন্ধ নেওয়ার সময় আমি ভাবি- মিটুল এ জীবন পেল না। নাজিয়াকে আদর করার সময় আমার মনে হয় মিটুল এ জীবন পেল না। কেন পেল না? অ্যাক্সিডেন্টের আগে মিটুল কেন সিট বদলেছিল ? মিটুল সিট না-বদলালে তো মারা যেতাম আমি ।
এই প্রশ্নটা আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে।
রেজওয়ান বৃষ্টি ভেজা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হয় মানবজীবনের কি নিয়তি নিদিষ্ট? এমন মনে হয় তার। সে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমি কেন বেঁচে আছি? মিটুল এর বদলে আমি কেন বেঁচে আছি? মিটুল কেন বেঁচে নেই। ওর কেন শনিবার ভোরে বাসের জানালার পাশের সিটে বসতে ইচ্ছে হল? কেন হল?
রেজওয়ান বিয়ের পর নাজিয়াকে কত কথা বলেছে। মিটুলের কথা নাজিয়াকে কখনও বলা হয়নি। ওই অ্যাক্সিডেন্টের পর পরই রেজওয়ানের বাবা খুলনায় বদলী হয়ে গেলেন। মিটুলের স্মৃতি রয়ে গেল মনের কোণে ... কেবল শনিবার ভোর এলে এক ধরনের অস্বস্তি হত ...
সেই মিটুল আজ এসেছিল।
কেন এসেছিল?